মুর্শিদাবাদের গৌরব - কাটরা মসজিদ

মুর্শিদাবাদের গৌরব - কাটরা মসজিদ

গোলাম হোসেন সেলিম তাঁর বই রিয়াজ-উস-সালাতিনে লিখছেন যে ষোড়শ শতকের কোন এক সময়, মখসুস খাঁ নামে এক উমরা, ভাগীরথী নদীর তীরে একটি সরাইখানা নির্মাণ করেন। এইভাবেই গোড়াপত্তন হয় একটি শহরের যার নাম হয় মখসুদাবাদ। ১৭০৪ খৃষ্টাব্দে যখন বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসেন এই শহরে, তখন তাঁর নামেই শহরের নাম হয়ে যায় মুর্শিদাবাদ। সেই মুর্শিদাবাদ শহরের সব থেকে বিখ্যাত ধর্মীয় স্থাপত্য হল কাটরা মসজিদ, যার সিঁড়ির নিচে শায়িত রয়েছেন খোদ মুর্শিদ কুলি খাঁ।

কাটরা মসজিদকে যে আর পাঁচটা মসজিদের থেকে এক্কেবারে অন্যরকম দেখতে, তার একটা কারণ মসজিদটি তৈরি একটি বিশাল, উঁচু চাতালের ওপর এবং তাকে ঘিরে রয়েছে একাধিক ছোট ছোট ঘর। আসল মসজিদ এর ভেতরে। কাটরা মসজিদের চারদিকে দোতলা ঘরগুলির যে ঘের রয়েছে, তার মাপ পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ৭৪ মিটার, এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে ৬০ মিটার। এই ঘেরের ভিতরের এক একটি কক্ষের মাপ আন্দাজ ২০ বর্গফুট। এই ঘেরের চার কোনে রয়েছে চারটি উঁচু মিনার। এক একটি মিনারের উচ্চতা ৭০ মিটার, এবং ব্যাসরেখা অর্থাৎ ডায়ামিটার ২৫ মিটার। পুবদিকের দুটি মিনারই সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাকি রয়েছে কেবল পশ্চিমের দুটি মিনার। পূর্ব থেকে পশ্চিমে আন্দাজ ৫৫ মিটার লম্বা এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে ৬০ মিটার চওড়া চাতালটি রয়েছে ঘেরের ভিতরে। চাতালের পশ্চিম দিকে রয়েছে আয়তক্ষেত্রাকার মসজিদটি।

মসজিদের পশ্চিমদিকের কক্ষ

মসজিদের পশ্চিমদিকের কক্ষ

চাতালে ওঠার জন্যে মসজিদের পিছনদিকেও সিঁড়ি আছে, যদিও প্রধান প্রবেশদ্বার, আর পাঁচটি মসজিদের মতই, পূর্ব দিকে। ১৪ ধাপ সিঁড়ি উঠে সামনে পড়ে চাতাল। বাকি চাতাল পোড়ামাটির হলেও, মাঝখানের একটি অংশ কালো পাথর দিয়ে বাঁধানো, যেন সিঁড়ি থেকে মসজিদের দরজা পর্যন্ত সোজা কালো একটা ফুটপাথ। পোড়ামাটির মধ্যে চৌকো চৌকো খোপ করা রয়েছে। এক একটি খোপ একজন করে মানুষের বসার পক্ষে যথেষ্ট। নামাজীদের জন্যে এইভাবে চাতালে যায়গা নির্ধারণ করে দেওয়া।

৪৫ মিটার লম্বা, এবং আন্দাজ ৭.৫ মিটার চওড়া মসজিদের পাঁচটি গম্বুজ ছিল এক সময়ে। ১৮৯৭ এর ভুমিকম্পে, মাঝখানের এবং দুই ধারের দুটি গম্বুজ বাদ দিয়ে, অন্য দুটি ভেঙ্গে পড়ে। তারই সঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে পূর্ব দিকের দুটি মিনার, এবং পশ্চিম দিকের দুটি মিনারের মাথার গম্বুজ। পূর্ণ চন্দ্র মজুমদার তাঁর বই The Musnud of Murshidabad লিখেছিলেন ১৯০৪ নাগাদ। তখন তিনি মুর্শিদাবাদের নবাবের প্রাইভেট সেক্রেটারি। সেই সময়েও তিনি মসজিদের মাঝের গম্বুজটি অক্ষত অবস্থায় দেখেন। আমার আন্দাজ, ১৯৩৪ সালে নেপাল এবং বিহারে যে বিধ্বংসী ভুমিকম্প হয়, তাতেই মাঝখানের গম্বুজটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তারই সঙ্গে একদিকে বেঁকে যায় মসজিদের দেওয়াল, যেটা আজও খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যায়।

মসজিদের পুবদিকের দৃশ্য

মসজিদের পুবদিকের দৃশ্য

১৭৮১ সালে মুর্শিদাবাদে গেছিলেন ইংরেজ শিল্পী উইলিয়াম হজেস। সেই সময়ে তিনি কাটরা মসজিদের একটি ছবি আঁকেন, যা পরবর্তীকালে তাঁর বই Select Views of India-তে প্রকাশিত হয়। হজেস তাঁর বর্ণনায় লেখেন যে সেই সময়ে কাটরা মসজিদ ইসলামী শিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল এবং ৭০০ শিক্ষানবিশ ঘেরের ওই ঘরগুলির মধ্যে থাকতেন, এবং কোরান পাঠ করতেন।

কিন্তু মসজিদের নাম কাটরা কেন? কাটরা কথাটির মানে বাজার। আজও কলকাতার বড়বাজারে গেলে, এই কাটরা কথার ব্যাবহার দেখা যায়। যেমন, চৌরুঙ্গিতে মনোহর দাশ তড়াগ যার নামে, সেই একই ভদ্রলোকের নামে বড়বাজারে রয়েছে মনোহর দাশ কাটরা। মুর্শিদ কুলি খাঁ, মসজিদের পশ্চিমদিকে একটি বাজার বসিয়েছিলেন। সেই বাজারের ছবি প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালের ২-রা জানুয়ারীর The Illustrated London News পত্রিকায়, যদিও সেখানে ভুল করে কাটরা মসজিদকে রাজপ্রাসাদ বলা হয়েছে। যেহেতু বাজারের পাশেই মসজিদ, সেই থেকেই নাম হয়ে যায় কাটরা মসজিদ। সেই বাজার আজও আছে, যদিও সেখানে সবজি এবং অন্য এক দুটি জিনিস ছাড়া আর তেমন কিছুই বিক্রি হয়না। সরকারি নথিপত্রে আজও এলাকার নাম সবজি কাটরা।

বিশাল খোলা চাতালের মাঝে কাটরা মসজিদ

বিশাল খোলা চাতালের মাঝে কাটরা মসজিদ

মসজিদের কাছে গিয়ে যদি আমরা পুবদিকের দেওয়ালের ওপরের দিকে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো বিশাল বিশাল লোহার আংটা দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আছে। একই সঙ্গে, এর থেকে ছোট বেশ কয়েকটা আংটা রয়েছে চাতালের পোড়ামাটির ওপরে। এগুলো হল বর্শাকালে বা কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যে শামিয়ানা টাঙানোর ব্যবস্থা। পুবদিকের দেওয়ালে পাঁচটি দরজা রয়েছে। খিলানের ভতরে দরজাগুলির ‘ফ্রেম’ কালো পাথরের। মাঝখানের দরজার ওপরে রয়েছে একটি পাথরের ফলক। ফলকে ফারসি ভাষায় যা লেখা রয়েছে, তার তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “আরবের মোহম্মদ, যিনি দুই জগতের গৌরব, তাঁর পায়ের ধুলো যেন তাঁদের মাথাতেও পড়ে, যারা তাঁর দরজার ধুলো হতে পারলেন না”। এমন অদ্ভুত একটি বাক্যের কি মানে হতে পারে? গবেষক আবুল বরকত জিলানী বলছেন যে এর অর্থ এই যে হজরত মোহম্মদের আশির্বাদ থেকে তাঁরাও যেন বঞ্চিত না হন, যারা হজে যেতে পারেন নি, এবং মদিনায় তাঁর কবর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। আর একটি কালো পাথরের ফলক রয়েছে মসজিদের ভেতরের পশ্চিম দিকের দেওয়ালের মেহেরাবের ওপরে। এই মেহেরাব একটি কুলুঙ্গির মত, যা পবিত্র কাবার দিকনির্দেশ করে, যেদিকে মুখ করে নামাজ পড়তে হয়। মেহেরাবের ওপরের ফলকে লেখা রয়েছে “লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্‌”। এর অর্থ আল্লাহ ব্যাতিত কোন উপাস্য নাই, এবং মোহম্মদ তাঁর প্রেরিত নবী।

দরজার ওপরের ফলকে মসজিদে নির্মানের তারিখ লেখা রয়েছে হিজরি মতে – ১১৩৭, অর্থাৎ ১৭২৪ খ্রিষ্টাব্দ। ফারসি বাক্যটির আর একটি ইঙ্গিতও রয়েছে। পুবদিকে চাতালে ওঠার সিঁড়ির নিচেই চিরনিদ্রায় শায়িত মুর্শিদ কুলি খাঁ। নিঃসন্দেহে তিনি এই জায়গাটিকে নিজের কবর হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কারণ নামাজীদের পায়ের ধুল তাঁর কবরের ওপরে পড়বে, এবং কোরান পাঠের শব্দও তাঁর কবর থেকে শোনা যাবে। অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মধ্যেই আমরা এই বিশ্বাস দেখতে পাই, যেখানে তাঁরা চান যে মৃত্যুর পরেও, তাঁদের কবরের কাছে যেন কোরান পাঠ করা হয়, যাতে স্বর্গে তাঁদের আত্মা শান্তি পায়।

মসজিদের ভেতরে দাঁড়িয়ে ওপরে তাকালে এই দৃশ্য দেখা যায় ভাঙ্গা গম্বুজের ভিতর দিয়ে

মসজিদের ভেতরে দাঁড়িয়ে ওপরে তাকালে এই দৃশ্য দেখা যায় ভাঙ্গা গম্বুজের ভিতর দিয়ে

মুর্শিদাবাদের টুরিস্ট গাইডরা মসজিদের ব্যাপারে নানান উল্টোপাল্টা, ভিত্তিহীন গল্প শোনায়। তার মধ্যে একটি হল মসজিদের গম্বুজের ওপরের ‘lotus finial’-এর ব্যাপারে। মনে রাখতে হবে যে যতদিনে কাটরা মসজিদ তৈরি হয়েছে, ততদিনে মোগল মসজিদ নির্মানের শৈলী আমাদের বাংলায় ঢুকে পড়েছে। এই ‘lotus finial’ সেই শৈলীর একটি অংশ এবং এর অন্য কোনো গুঢ় অর্থ নেই। দ্বিতীয়, মসজিদের ঠিক দক্ষিনে একটি শিব মন্দির দেখিয়ে গাইডরা বলেন যে সেই মন্দিরের নাকি নির্মান করিয়েছিলেন মুর্শিদ কুলি খাঁ। মন্দিরের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেই বুঝতে পারবেন যে মন্দিরটি একেবারেই নতুন, তার সঙ্গে মুর্শিদ কুলি খাঁ কেন, মুর্শিদাবাদের কোনো নবাবের সম্পর্ক নেই। গাইডরা মসজিদের তিনটি যায়গায় মন্দিরের পোড়ামাটির ফলকের টুকরো দেখিয়ে এও দাবি করেন যে কাটরা মসজিদ নাকি মন্দি ধ্বংস করে তৈরি করা। বলাই বাহুল্য এই দাবিও ভিত্তিহীন। মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ তৈরি করলে, মন্দিরের আরও অনেক ধ্বংসাবশেষ মসজিদে দেখা যেত, এবং তাছাড়াও, মুর্শিদ কুলি খাঁ মন্দির ধ্বংস না করে, বরং একাধিক মন্দিরকে যে জমি দান করেছিলেন, তার প্রমাণ আছে।

দিনের প্রথম আলো ঢুকছে কাটরা মসজিদে

দিনের প্রথম আলো ঢুকছে কাটরা মসজিদে

কাটরা মসজিদ সাধারণত পর্যটকরা বিকেলের দিকে যান। আমার একটাই অনুরোধ। সকালে কাটরা যান। ফাঁকা মসজিদে প্রথম সুর্জের আলো প্রবেশের দৃশ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করবেন না।

মিয়াঁ হিলাল মসজিদ, মুর্শিদাবাদ

মিয়াঁ হিলাল মসজিদ, মুর্শিদাবাদ

সংরক্ষণ বিভ্রাটঃ নুতনহাট টেরাকোটা মসজিদ

সংরক্ষণ বিভ্রাটঃ নুতনহাট টেরাকোটা মসজিদ